অন্যান্য

কেন নিঃসন্তান থাকেন পুরুষরা, জানা গেল আসল কারণ

বিশ্বজুড়ে ক্রমেই প্রজনন হার কমছে। তবে ঠিক যতটা কমবে বলে ধারণা করা ছিল, তার থেকেও বেশি কমছে। চীনে জন্মহার অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয় জন্মের হার পূর্বাভাসের তুলনায় অনেক কমেছে। আবার মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায়ও জন্মহার প্রত্যাশার থেকে অনেকটাই কমে গেছে। বর্তমান বিশ্বে মানুষজন আগের থেকে কম সন্তান নিচ্ছে। শুধু এই নয়, একইসঙ্গে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই অনেকেই আর সন্তান নিতে আগ্রহী হচ্ছে না।

সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলম্বিয়ায় ইসাবেলে নামের এক নারীর বয়স যখন তিরিশের কোঠায়, তখন খুবই খারাপভাবে বিচ্ছেদ হয় তার। ওই সময় সিদ্ধান্ত নেন, মা হবেন না। তারপর মা হতে আগ্রহী নয় এমন নারীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মাদ্রেস নামে অ্যাডভোকেসি গ্রুপ। আর তার এই ধরনের সিদ্ধান্তের জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। নিজ দেশের বাইরেও বিভিন্নভাবে সমালোচনার শিকার হন তিনি।

ইসাবেলে বলেন, আমাকে সব থেকে বেশি যে কথাটি শুনতে হয় তা হলো এই সিদ্ধান্তের জন্য একটি পস্তাবেন, আপনি স্বার্থপর। আপনি বুড়া হলে কে আপনার যত্ন নেবে? তবে সন্তানহীন জীবন কাটানোকে কেবলই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তার। আবার এটি অনেকের কাছে শারীরিক বন্ধ্যাত্বের কারণও। এছাড়া শারীরিক অক্ষমতার জন্যও অনেক মানুষ সন্তানহীন থাকেন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ বা কিছু কারণের সমষ্টি দায়ী হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ পুরুষরা সন্তান নিতে আগ্রহী হলেও সেই সক্ষমতা নেই তাদের। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পুরুষদের। ২০২১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নরওয়েতে যে পাঁচ শতাংশ পুরুষের আয় কম, তাদের সন্তানহীনতার হার কমপক্ষে ৭২ শতাংশ। বিপরীতে সর্বোচ্চ উপর্জনকারী পাঁচ শতাংশের মধ্যে সন্তানহীনতার হার ১১ শতাংশ। আর এই ব্যবধান গত তিন দশকে প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সামাজিক বন্ধ্যাত্ব বেড়ে যাওয়া: সামাজিক বন্ধ্যাত্বর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। সন্তান ধারণের জন্য সম্পদের অভাব বা সঠিক সময় সঠিক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা না হওয়াও অন্যতম কারণ। আর এর পেছনে অন্য কারণ রয়েছে বলে মনে করেন ফিনল্যান্ডের পপুলেশন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের একজন সমাজবিজ্ঞানী এবং জনসংখ্যাবিদ আনা রটকির্চ।

এ জনসংখ্যাবিদ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপ ও ফিনল্যান্ডে ‘ফার্টিলিটি ইনটেনশন’ বা প্রজননের উদ্দেশ্য নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তিনি জানান, সন্তান ধারণের ব্যাপারটা যেভাবে দেখেন তারা, তাতে এর পরিবর্তনটা ব্যাপক। এশিয়ার বাইরে ফিনল্যান্ডে সন্তানহীনহার অনেক বেশি। অথচ ফিনল্যান্ড তাদের ক্রমশ হ্রাস পাওয়া জন্মহারের সঙ্গে ১৯৯০ এবং ২০০০ এর দশকের শুরু থেকে লড়াই করার জন্য শিশুবান্ধব নীতি প্রণয়ন করে। যা বিশ্বের অন্যতম শিশুবান্ধব নীতি হিসেবে স্বীকৃত।

ফিনল্যান্ডে সন্তান জন্মের হার বৃদ্ধিতে মা-বাবার ছুটিতে উদারনীতি নিশ্চিত করা হয়েছে। দেশটিতে শিশুর যত্ন যতটা সম্ভব সাশ্রয়ী করা হয়। আবার নারী-পুরুষরা ঘরের কাজে যেন সমানভাবে অংশ নিতে পারে, সেটিও নিশ্চিত করা হয়। আর দেশটিতে ২০১০ সাল থেকে শিশু জন্মাহার হ্রাস পায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

জনসংখ্যাবিদ রটকির্চ বলেন, বিয়ের মতো সন্তান ধারণকে একটা সময় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হতো। একজন মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরই বিয়ে করে অল্প সময়ের মধ্যেই সন্তান নিতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেটির বিপরীত দৃশ্য দেখা যায়। এখন প্রায় মানুষই জীবনের অন্যান্য লক্ষ্য পূরণের পর তবেই সন্তান নেয়ার কথা ভাবেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ধারণা, একটি সন্তান হলে তাদের জীবনে যোগ হবে অনিশ্চয়তা।তিনি দেখেছেন, ফিনল্যান্ডে ধনী নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সন্তান হওয়ার আশঙ্কা কম। অর্থাৎ, তারা সন্তান নিতে চাচ্ছেন না পারছেন না, এমনটা তেমন হয় না। তারা মূলত নিজ ইচ্ছাতেই সন্তান না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। বিপরীতে নিম্ন আয়ের পুরুষরা ইচ্ছা না থাকার পরও সন্তানহীন অবস্থায় থাকার আশঙ্কা বেশি। আর অতীতের সঙ্গে বর্তমান সময়ের এখানে বড় ব্যবধান দেখা যায়। আগে দরিদ্ররা দ্রুত পরিণত হতেন। আগেভাগে পড়ালেখা শেষক করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতেন এবং অল্প বয়সে পরিবার শুরু করতেন।

পুরুষতন্ত্রের সংকট: পুরুষদের ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দেয়ার সম্ভাবনা কমে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আর্থিক অনিশ্চয়তা। যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন ‘দ্য সিলেকশন এফেক্ট’ বা ‘বেছে নেয়ার প্রভাব।’ এখানে নারীরা তাদের সঙ্গী নির্বাচনের সময় একই সামাজিক শ্রেণি বা নিজের থেকে উচু শ্রেণির মানুষ খুঁজেন।

রবিন হ্যাডলি নামের এক পুরুষ বলেন, আমি বুঝতে পেরেছি যে আমি আমার আওতাার বাইরে অন্ধের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তার সম্পর্ক অবশ্য ত্রিশের কোঠায় ভেঙে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয় আমার এই পরিস্থিতির জন্য সিলেকশন এফেক্ট বড় কারণ হতে পারে।তিনি জানিয়েছেন, প্রায় ৪০ বছর বয়সে তার বর্তমান স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়। এই সঙ্গী তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া এবং পিএইচডি অর্জনে সহায়তা করেছেন। সে না থাকলে হয়তো এ অবস্থানে আসতে পারতেন না। তবে তারা যখন সন্তান নেয়ার কথা ভাবছিলেন, তখন তাদের বয়স চল্লিশের কোঠায় ও তা অনেক দেরি হয়ে গেছে বলে জানান।বিশ্বজুড়ে ৭০ শতাংশ দেশে নারীরা শিক্ষাদীক্ষায় পুরুষদের অতিক্রম করছে। আর এটাকে ‘দ্য মেইটিং গ্যাপ’ বা ‘সঙ্গমের ব্যবধান’ বলে অভিহিত করেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী মার্সিয়া ইনহর্ন।।

অদৃশ্য জনগোষ্ঠী: অধিকাংশ দেশেই পুরুষদের সন্তান নেয়ার ক্ষমতা নিয়ে খুব একটা তথ্য-উপাত্ত নেই। কেননা, জন্ম নিবন্ধনের সময় শুধু মায়ের প্রজননের ইতিহাস রেকর্ড করা হয়। অর্থাৎ, সন্তানহীন পুরুষদের জন্য কোনো স্বীকৃত ধরন বা ক্যাটাগরি নেই। যদি কিছু নর্ডিক দেশ মা-বাবা উভয়ের প্রজননের তথ্য নিয়ে থাকে। নরওয়েজিয়ান সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধনী ও দরিদ্র পুরুষদের মধ্যে সন্তান জন্মাদানে বৈষম্য রয়েছে অনেক। এমনকি অসংখ্য পুরুষের সন্তান গ্রহণে পিছিয়ে থাকার কথাও বলা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরুষদের স্বাস্থ্য এবং প্রজনন বিশেষজ্ঞ ভিনসেন্ট স্ট্রব বলেছেন, জন্মহার কমে যাওয়ায় পুরুষদের ভূমিকাই অধিকাংশ সময় উপেক্ষিত থাকে। প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়ার পেছনে পুরুষদের অস্বস্তিবোধের ব্যাপারে জানতেও আগ্রহী ভিনসেন্ট স্ট্রব। আর এই অস্বস্তিবোধের বিষয়টি তরুণদের মধ্যে দেখা যায়। বর্তমান সময়ে সমাজে একদিনে নারীদের ক্ষমতায় হচ্ছে, একইসঙ্গে পুরুষত্ব ও তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যাকে ‘পুরুষত্বের সংকট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ভিনসেন্ট স্ট্রব বলেছেন, যেসব পুরুষরা শিক্ষগত যোগ্যতায় পিছিয়ে তাদের অবস্থা আগের দশকের পুরুষদের থেকে তুলনামূলক অনেক খারাপ। তিনি জানিয়েছেন, অনেক উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জন্য বাস্তবশিক্ষামূলক কাজের মূল্য কমে গেছে। এ জন্য যারা শিক্ষাগত যোগ্যতায় পিছিয়ে আছেন, তাদের অবস্থা অনিরাপদ। আবার যারা উচ্চশিক্ষিত বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি রয়েছে এবং যাদের নেই, তাদের মধ্যকার ব্যবধানের পরিমাণও অনেক বেড়েছে।

এ জন্য পুরুষদের সঙ্গে নারীর সঙ্গমের ব্যবধান বেড়েছে। এটি পুরুষদের স্বাস্থ্যের ওপর অনেক বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ভিনসেন্ট স্ট্রব বলেছেন, বিশ্বজুড়ে মাদকের অপব্যবহার বেড়েছে এবং প্রজননের বয়সে থাকা পুরুষদের মধ্যে এই হার অনেক বেশি। হতে পারে তা আফ্রিকা বা দক্ষিণ বা মধ্য আমেরিকায়। আর সামাজিক ও শারীরিক সক্ষমতার ওপর এই সবকিছুরই ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে প্রজননের যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করি আমি।

উপায় কী: ভিনসেন্ট স্ট্রব ও রবিন হ্যাডলি দেখেছেন, প্রজনন নিয়ে হওয়া সব আলোচনা শুধু নারীকে নিয়ে হয়। আবার জন্মহার বৃদ্ধিতে যে নীতিগুলো প্রণয়ন করা হয়, তাতে অর্ধেক জনগোষ্ঠী অর্থাৎ পুরুষদের বাদ দেয়া হয়। এ ব্যাপারে ভিনসেন্ট স্ট্রবের ভাষ্য, প্রজননকে পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। আর প্রতিটি বাবার যত্ন নেয়ার ব্যাপারেও আলোচনা করতে হবে।

তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় প্রতি ১০০ পুরুষের মধ্যে একজন সন্তান দেখভালের জন্য কর্মজীবন থেকে বিরতি নিয়ে থাকেন। আর নারীদের ক্ষেত্রে এই হার প্রতি জনের মধ্যে একজন। বিষয়টি নিয়ে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে, সন্তানকে লালনপালন করা পুরুষদের স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো।
রবিন হ্যাডলি বলেছেন, পুরুষদের আরও ভালো তথ্য প্রয়োজন। যতক্ষণ না পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতার ব্যাপারটি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার আগ পর্যন্ত বিষয়টি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে, সেটি ভালোভাবে বুঝতে পারব না।

এছাড়া তথ্য-উপাত্ত ছাড়াও প্রজনন সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনায় গুরুত্বহীন বা অনুপস্থিত থাকে পুরুষ। তবে নারীদের প্রজনন নিয়ে সচেতনতা দেখা গেছে। নারীদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রজনন ক্ষমতা কমতে থাকে, এটি নিয়েও ভাবার সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা নিয়ে সেভাবে এখনো আলোচনা হয় না।

রবিন হ্যাডলি বলেছেন, সত্য হচ্ছে নারীদের মতো পুরষদেরও জৈবিক চক্র রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে ৩৫ বছরের পর পুরুষদের শুক্রাণুর কার্যকারিতা কমতে থাকে। আর এই অদৃশ্য গোষ্ঠীকে (পুরুষ) দৃশ্যমান করা সামাজিক বন্ধ্যাত্ব মোকাবিলার অন্যতম উপায়।

মতামত দিন