দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলার পেছনে ‘উদ্দেশ্যমূলক ইন্ধন’ দেখছে সেনাবাহিনী
দেশব্যাপী নানা ধরনের বিশৃঙ্খলার পেছনে ‘উদ্দেশ্যমূলক ইন্ধন’ দেখছে সেনাবাহিনী। তারা বলছে, দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করাই এদের উদ্দেশ্য। তবে এ ইন্ধনদাতা কারা, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু বলা হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সেনাসদর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়।দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গত দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা দিতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ ইন্তেখাব হায়দার খান।ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, ‘সেনাবাহিনীর পদক্ষেপের কারণে অনেক ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটছে না। যেগুলো ঘটছে সেগুলোও যেন থেমে যায়, সেজন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে সেনাবাহিনী। তবে ছাত্র ও শ্রমিকদের মতো সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে যখন সেনাবাহিনীর শক্তি প্রয়োগের বিষয় আসে, তখন অনেক চিন্তা করে এগোয় সেনাবাহিনী। সেজন্য হয়তো অনেকে মনে করতে পারেন যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি।’এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি বা যেসব প্রতিবাদ বা অস্থিরতা হচ্ছে, এগুলো করছে মূলত তিন ধরনের মানুষ। একটা হলো যারা চিহ্নিত অপরাধী, যাদের কাজই হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করা। আরেকটা হচ্ছে ইন্ধনদাতা, যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অনেক কিছু করছেন। আরেকটা পক্ষ হচ্ছে দেশের সাধারণ জনগণ। এই যে ছাত্রদের আন্দোলন, পোশাক খাতের শ্রমিকরা আন্দোলন করছে, এরা কিন্তু আপনার-আমার মতো সাধারণ জনগণ। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাটা থাকবে প্রথম দুপক্ষ অর্থাৎ অপরাধী আর ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে। আর সাধারণ জনগণের বিপক্ষে আমাদের যখন দাঁড়াতে হয়, তখন আমাদের অনেক চিন্তা করে কাজ করতে হয়।’ইন্ধনদাতা কারা, তাদের বলার মতো কোনো পরিচয় আছে কি না এবং তাদের উদ্দেশ্য কী এমন প্রশ্নে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, ‘তাদের পরিচয় এখন সুনির্দিষ্ট বলতে পারব না। কিন্তু তারা কী চায় সেটা আপনি-আমি সবাই জানি। তারা দেশে একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। তাদের এক ধরনের মোটিভ (উদ্দেশ্য) আছে এটা বলছি না, একেকজনের একেক ধরনের উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এখানে ব্যক্তিস্বার্থ থাকতে পারে, সামষ্টিক স্বার্থ থাকতে পারে। এ ধরনের ইন্ধনদাতা থাকবেই, এটা শুধু বর্তমান পরিস্থিতিতে না, যেকোনো দেশ যখন শান্তিকালীন পরিস্থিতিতে থাকে, তখনো এরকম অনেক ধরনের হতে পারে। একটা দেশে অনেক রকমের বিষয় থাকে ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক। ইন্ধনদাতারা সবসময় ছিল, থাকবে। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ জনতা তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ইন্ধনে প্ররোচিত না হওয়া।’সামাজিক মাধ্যমে ইন্ধন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখানে আমাদের দায়িত্বশীলতার বিষয়ও আছে। এই যে ইন্ধনদাতারা একটা কিছু পোস্ট করার পর অন্য অনেকে সেটা কপি করছেন। তারা আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যারা না বুঝেই অনেক কিছু ছড়িয়ে দেন। যার ফলে অনেক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।’
অন্য একটি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্ররাই কিন্তু আন্দোলন করে দেশের এমন একটা পরিবর্তন এনেছে। আমরা সবাই আশা করছি যে, দেশটা একটা ভালো দিকে যাবে। ছাত্ররাই যখন কারও ইন্ধনে পরিস্থিতি না বুঝে সাময়িকভাবে ভুল পথে যাচ্ছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে আমরা যদি শক্তি প্রয়োগের কথা চিন্তা করি... তখন আমাদের কিন্তু অনেক চিন্তা করে কাজটা করতে হয়। আমরা আশা করি ছাত্ররা বা সাধারণ মানুষ যারা আছে প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝবেন। আর সামাজিকমাধ্যম বা যে কোনো মাধ্যমে কোনো উসকানি এলে সবাই যেন যাচাই করার চেষ্টা করেন যে, আসলে ঘটনাটি কী ঘটছে।’
চট্টগ্রামে সংঘাতে সেনাবাহিনীর কী ভূমিকা ছিল : সনাতনী জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে এক আইনজীবীকে হত্যার ঘটনাটি নিয়েও প্রশ্ন রাখা হয় সেনা কর্মকর্তা ইন্তেখাবের কাছে। ‘সহিংসতা হতে পারে’ ধারণা থাকার পরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর ঘটনাটি অবশ্যই অনেক বেদনাদায়ক। আমাদের সার্বিক চেষ্টা থাকে যেকোনো ধরনের মৃত্যু প্রতিরোধ করার। আপনি জানতে চেয়েছেন সেখানে আমাদের প্রস্তুতি ছিল কি না, আবার আপনি নিজেই বলেছেন সেখানে আগে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল। আমাদের সক্রিয়তার কারণেই হয়তো অনেক বড় ঘটনা সেখানে ঘটেনি। আপনারা জানেন সেখানে বিক্ষোভকারীরা সংখ্যায় অনেক ছিল। সেই পরিস্থিতিতে কিন্তু সেখানে আরও খারাপ ঘটনা ঘটতে পারত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে সেরকম কিছু হতে পারেনি।’
যাত্রাবাড়ীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা শ্রমিকদের সংঘাতের মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেক দেরিতে গিয়েছেন এবং তারা ঘটনাস্থলে গিয়েও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বলে একজন সংবাদকর্মী প্রশ্ন রাখেন। জবাবে সেনা কর্মকর্তা ইন্তেখাব বলেন, ‘যাত্রাবাড়ীর ঘটনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এর মধ্যেই বক্তব্য দিয়েছেন। তবে প্রত্যেকটা ঘটনা আলাদা করে বিচার করার প্রয়োজন আছে।’সেনাবাহিনী গোয়েন্দা তথ্যের কোনো ঘাটতি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘাটতি আছে আমি বলব না। গোয়েন্দা তথ্যের বিষয়ে সবার সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানে না এরকম কোনো ঘটনা হয়নি। এটার ব্যাখ্যা তো আমি আগেই দিয়েছি যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের অনেক চিন্তা করে কাজ করতে হচ্ছে। সেজন্য হয়তো অনেকে মনে করতে পারেন যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু আমরা তো শুধু সামনেরটা দেখি।’
কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার আরও বলেন, ‘কোনো কিছু ঘটতে যাচ্ছে এরকম যখন শোনা যায় তখন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই এনগেইজমেন্টে যাওয়া হয়। এভাবে কিন্তু অনেক ঘটনাকে কিন্তু প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। যে ঘটনা ঘটেনি এগুলো তো কেউ জানছে না। তারপরও আমরা সম্পূর্ণভাবে সব আটকাতে পারিনি। তবে ঘটনাগুলো যেন একটা সার্টেইন লেবেলের ওপরে না যায় এবং তাড়াতাড়ি তা থামানো যায়; সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
যৌথ বাহিনীর অভিযান চালাতে গিয়ে অপরাধে জড়িয়েছে শোনা যায়, এরকম কতজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এ প্রশ্নে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেন, ‘যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আছেন তারা অপরাধে জড়িয়েছেন এরকম ঘটনা হয়তো ঠিক নয়। তবে কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলোতে হয়তো সেনাসদস্য বা অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আমার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য এখন নেই। তবে যত অভিযোগ আসছে প্রত্যেকটার তদন্ত হচ্ছে, কিছু তদন্ত শেষ হয়েছে। আমার জানামতে এখানে পাঁচ বছরের থেকে শুরু করে এক বছরের জেল, চাকরি থেকে বরখাস্তসহ বিভিন্ন রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার : কর্নেল ইন্তেখাব জানান, গত ১৩ নভেম্বর থেকে দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনী ২৪টি অবৈধ অস্ত্র এবং ৩৬৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে, অপরাধে সম্পৃক্ত ১ হাজার ৩২৮ জন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ২০ জুলাই কারফিউয়ের দিন থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর ১২৩ জন সদস্য হতাহত হয়েছেন বলেও জানান তিনি। এর মধ্যে একজন অফিসার নিহত হয়েছেন, নয়জন অফিসার বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৪০টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ১৮টি সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। শিল্পাঞ্চল ছাড়াও ৬৩টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৬টি, সরকারি অফিস-সংক্রান্ত একটি, রাজনৈতিক কোন্দল ৬টি এবং অন্যান্য ঘটনা ৪০টি।
বৌদ্ধদের দেশব্যাপী কঠিন চীবরদান উৎসব, সনাতন ধর্মাবলম্বী মাতুয়া গোষ্ঠীর রাসমেলা ও নবান্ন উৎসব উদযাপনের জন্য নিরাপত্তা দিয়েছে সেনাবাহিনী।
কুকি-চিনের বিরুদ্ধে অভিযান : পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ যৌথ অভিযান গত এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত ১৭৯ জন কেএনএফ সক্রিয় সদস্য ও সহায়তাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
এসব অভিযানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ ৬০টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ ও দুরবিন, ম্যাপ, আইডি সরঞ্জাম, ওয়াকিটকি, ইউনিফর্ম ইত্যাদি সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। কুচি-চিনের পুঁতে রাখা আইইডি বিস্ফোরণ এবং অতর্কিত হামলায় সেনাবাহিনীর সাতজন সদস্য নিহত হয়েছেন।
আন্দোলনে আহতদের সিএমএইচে চিকিৎসা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন, তাদের ৩ হাজার ৪৩০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় বলেও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। তাদের মধ্যে ৩৫ জন এখনো চিকিৎসাধীন। সিএমএইচগুলোতে দেড় হাজারের বেশি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫৩টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার। এ ছাড়া চারজন গুরুতর আহত রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মতামত দিন