অন্যান্য

আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রমজান

মুসলিম উম্মাহর উঠোনে বসন্ত এসে গেছে। পাপের ধুলোয় মলিন অন্তর পুণ্য দিয়ে ঢেকে দিতে, দরজায় ঠকঠক কড়া নাড়ছে পবিত্র রমজান। আত্মশুদ্ধি, অতুলনীয় মানবিক আচরণ, সাম্য ও সহমর্মিতা শিক্ষার অনুপম বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে আবার এলো মাহে রমজান। রমজান পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস এবং ঐতিহাসিক বিজয় ও ইসলামের ভিত্তি মজবুত মাস।রমজান মুসলিম উম্মাহর জন্য রহমত, বরকত, নাজাতের দ্বার উন্মোচিত করে। তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির অবারিত সুযোগ তৈরি করে দেয়। আর মুসলিম উম্মাহর অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত  ও সংস্কৃতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। মুসলিম উম্মাহর গুনাহ মাফের মোক্ষম হাতিয়ার হলো রমজান। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি যেমন সকল ময়লা আবর্জনা দুয়ে মুছে মাটিকে পরিচ্ছন্ন করে দেয়, ঠিক একইভাবে রমজান মানুষের পাপতাপ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পরিশুদ্ধ করে দেয়।

 
রমজানকে তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির মাস হিসেবে কুরআন ও হাদিসের উল্লেখ করা হয়৷ আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সুরা বাকারা আয়াত - ১৮৩)। এছাড়াও দায়িত্ববোধ ও সময়ানুবর্তিতা এবং বিশেষ করে, আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন পরিচালনার প্রশিক্ষণও বলা হয়ে থাকে।   

রমজান মুসলমানদের বিশেষ প্রশিক্ষণ

আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তাঁর খলিফা (প্রতিনিধি) হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা প্রতিনিধিদের একটি বিশেষ লক্ষ্যেই সৃষ্টি করেছেন। আর আল্লাহর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কেউ বেখবর নয়। দুনিয়াতেও আমরা দেখি, পীর সাহেবের প্রতিনিধি, কোম্পানির প্রতিনিধি আরো অনেক প্রতিনিধি আমাদের চোখে পড়ে। আর উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পীর ও কোম্পানি প্রতিনিধিদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন, যাতে তারা মানুষদের আকৃষ্ট করতে পারে। 
 
আর আল্লাহ তায়ালা মানুষদের আনুষ্ঠানিক ইবাদত যেমন নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতসহ নানা কৌশলে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। যাতে মানুষ তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারে৷ তন্মধ্যে রোজা হলো সমুদ্রের শৈবালের মতো বিশুদ্ধ অক্সিজেনের আঁধার। যা বারোমাস মুমিনের অন্তর পরিশুদ্ধ ও শান্তির সুবাতাস বইতে সাহায্য করে।
 
রমজান মুসলমানদের জন্য বসন্ত

জরাজীর্ণ শীতের ঋতুর শেষে বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। মুসলমানরাও রমজানের আগমনে সাজে নতুন সাজে। প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন টের পাওয়া যায় গাছে গাছে নতুন কচি পাতা এবং ফুলের মৌ মৌ গন্ধে। আর রমজানের আগমন টের পাওয়া যায়, মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগিতে তন্ময় হওয়া দেখে। রমজান মুমিন অন্তরে আল্লাহর ভয় ও উত্তম চরিত্র গঠনের শিক্ষা দেয়। 
 
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন আমল জান্নাতে প্রবেশের জন্য বেশি সহায়ক হবে? মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহর ভয় ও উত্তম চরিত্র। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০০৪)। প্রকৃতির বসন্ত চলে গেলেও মুসলমানদের এই বসন্ত থাকুক আমৃত্যু।
 
সাওয়াবের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে রমজান
 
মসজিদের মিনারে যখন আল্লাহু আকবর ধ্বনি উঠে তখন ধনী দরিদ্র সকল শ্রেণি পেশার মানুষ কাজ ফেলে শামিল হয় নামাজে। রমজান যেন সাম্যের কবিতা। কাঁটা ছেড়া ও জরাজীর্ণ জীবন শুভ্রতা মেখে, এঁকে দেয় সাওয়াবের মহাকাব্য। কুরআনের পাখিদের সুমধুর আবৃত্তি যেন কোকিলের কলতান। যা বিমোহিত করে কোটি মুসলমানের প্রাণ। 
 
তারাবি ও তাহাজ্জুদ নামাজে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ করে অশ্রুসিক্ত লোচনে, যা মরুভূমিতেও শীতলতা সৃষ্টি করে। আর সৃষ্টিকর্তার অফুরন্ত সাওয়াবের ভাণ্ডার মুমিন বান্দাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, 
 
যে ব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনবে, তাকে কয়েক গুণ বেশি সওয়াব প্রদান করা হবে, আর যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত করবে, তা তার জন্য কেয়ামতের দিন আলো হয়ে উদ্ভাসিত হবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৮৪৯৪)। 
 

অন্তরের রোগ সঙ্কীর্ণতা, অহংকারসহ কিছু মুছে সাদা কাগজের মতো পরিষ্কারে দেয় কুরআন। মানুষের হেদায়াতের দ্বার উন্মোচিত করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত। (সুরা ইউনুস আয়াত : ৫৭)।
 
রমজান পাপে লাগাম টানে

ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়েদের অবাধে মেলামেশা, ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলের বেহায়াপনা দেখে শয়তানও হতবাক কিন্তু যুবক-যুবতিদের চোখে আকাশ ভরা তারা। এছাড়াও পড়া মহল্লায় বন্ধু মহলের লাগামহীন আড্ডায় রমজান যেন বাগডোর। 
 
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে পাপ, মিথ্যা কথা, অন্যায় ও মূর্খতাসুলভ কাজ ত্যাগ করতে পারে না, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)।  

অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কখনো বা দরজায় ঘুরে ঘুরে সেবাগ্রহীতা শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার ঘুষ না দিয়ে; অতঃপর ঘরে ফিরে মলিন মুখে। বাজারে সিন্ডিকেট ও মুনাফাখোর, ব্যবসায় কালোবাজারি, সুদের কারবারি, আচার আচরণে অস্বাভাবিকতায় রমজান যেন আগডোর। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের কেউ সাওম পালন করলে সে যেন পাপাচারে লিপ্ত না হয় এবং মূর্খের মতো আচরণ না করে। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৬৩)।
 
বোনাসের মাস রমজান

কর্মচারীদের কাজে উদ্দীপনা বাড়ায় বাড়তি বোনাস। উৎসবের আনন্দে ইন্ধন দেয়া, নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অধিক প্রদানের আশ্বাসবাণীতে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন, 
যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবসহ রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।(সহিহ বুখারী: ৩৮, সহিহ মুসলিম:৭৬০)। 

তাই রমজান মাসে বেশি বেশি কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন, ইসলামি সাহিত্য অধ্যয়ন এবং নেক আমল করা। অন্তরের রোগ তথা অহংকার, দ্বন্দ-কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনৈতিক কর্মকাণ্ড করা এবং উৎসাহিত করা থেকে বিরত থাকা। এছাড়াও নিজেকে পরিমার্জিত করার আশায়; ধনী শ্রেণির মানুষ নিজের সম্পদ থেকে মুক্ত হস্তে দরিদ্রকে দান করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
 
আপনি তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন। আর আপনি তাদের জন্য দো'আ করুন। আপনার দোয়া তো তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সুরা তওবা আয়াত : ১০৩)। 

রমজান শুধুই উপবাস থাকা নয় বরং উপবাসের পাশাপাশি আল্লাহর আদেশ নিষেধ পরিপূর্ণভাবে পালন করা যেমন মিথ্যা কথা, পরচর্চা, অশ্লীলতা, মুনাফাখোরি, সিন্ডিকেট, প্রতারণাসহ শরিয়ত বিরোধী কাজ থেকে নিজে বিরত থাকা ও মানুষকে উৎসাহিত না করা এবং সামর্থ্য থাকলে নিষেধ করা। আমরা সব সময় একটা কথা বলে থাকি, সেটা হলো প্রোডাক্টিভ কাজ করতে হবে। 
 
কিন্তু রমজানের বেলায় উদাসীনতা কেন? প্রত্যেকটি কাজ প্রোডাক্টিভ করতে, চাই সঠিক পরিকল্পনা। তাই রমজানকে পরিকল্পনাভাবে অতিবাহিত করা যেমন প্রথমে পুরো রমজানের পরিকল্পনা করা। সেটা হতে পারে তাহাজ্জুদ, অর্থসহ  কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন, ইসলামি সাহিত্য পাঠ, কুরআনের ভাষা আরবি শেখা, ইতেকাফ, গরিবদের ইফতার ও সেহরির দায়িত্ব, নিজের রুচিসম্মত আত্মার সম্পাদনার কাজ হতে পারে। 
 
তারপর দশ দিন করে টার্গেট নিয়ে কাজ করা এবং পর্যালোচনা করা। প্রতিদিন আল্লাহর উপর ভরসা করে রুটিনমাফিক রিপোর্ট (অর্থাৎ রাতে দিনের কাজের খসড়া) অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। যা বাকি এগারো মাস জীবন চলার সংবিধান হবে। 
 
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে মনন-মানস উন্নয়ন হবে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন হবে। যা ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ সহজ করে দিবে। হে আল্লাহ, প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে মুক্ত করে, আমাদের রমজানের পরিপূর্ণ হক আদায় করার শক্তি দাও। আমরা যেন আপনার নৈকট্য লাভ করতে পারি, সেই তাওফিক দান করুন।
 
লেখক: প্রাবন্ধিক  

মতামত দিন